বুধবার, ১৫ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ১লা জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মোদির ‘আচ্ছে দিন’ কংগ্রেস জোটের ভরাডুবির নেপথ্যে

নিউজ ডেস্ক []মোদি ১ এর চাইতেও মোদি ২ আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে দিল্লির মসনদে ফিরেছে। ভারতীয় মিডিয়ার মন্তব্য ছিল এরকমই। নানা বিতর্ক পেরিয়ে আবারও নরেন্দ্র মোদি ভারতবাসীর মন জিতে নিয়েছেন। আবারও তার কাঁধেই থাকবে দেশের ভার। বিরোধীদের সব কৌশল, চেষ্টাকে বিফল করে এবারের নির্বাচনে তার নেতৃত্বাধীন বিজেপি আসন সংখ্যায় ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। ৫৪২ আসনের মধ্যে সর্বশেষ ঘোষিত ৫০৮ আসনের ফলে বিজেপি জোট পেয়েছে ৩৫২ আসন।

অন্যদিকে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ জোট পেয়েছে ৯১ আসন। বাকিরা পেয়েছে ৬৫ আসন। দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় ফিরে তিনি বলেছেন, এটা তার বা তাদের দলের জয়ই শুধু নয়, দেশের জয়, গণতন্ত্রের জয়। এবার লোকসভা নির্বাচনে বিরোধীদের টার্গেট ছিলেন তিনিই। কিন্তু তার উত্থান আটকাতে পারেননি কেউই। এবারের নির্বাচন নিঃসন্দেহে একটা বড় পরীক্ষা ছিল মোদির। সেই পরীক্ষায় সাফল্যের সঙ্গে উতরে গিয়ে মোদি আরও একবার প্রমাণ করেছেন, তার বিজয় রথের চাকা থামেনি, বরং তা আরও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। তার দেখানো উন্নয়নের পথেই বিশ্বাস রেখেছে ভারতীয়রা।
২০১৪ সালে যেখানে বিজেপি এককভাবে পেয়েছিল ২৮২ আসন এবার সেটা পেরিয়ে গেছে তিনশোর মাইলফলক। আর জোটবদ্ধ হয়ে সাড়ে তিনশোরও বেশি আসন বিজেপির। লোকসভায় দ্বিতীয় বৃহত্তম একক দল হিসেবে কংগ্রেস আসন সংখ্যায় শুধুই হাফসেঞ্চুরি করতে পেরেছে। কাজেই বিজেপি বাকি দলগুলোর ধরাছোঁয়ার বাইরে। একক বৃহত্তম দল হিসেবেই বিজেপি এখন ভারতের শাসনকর্তা। বিপরীতে একসময়ের শাসক দল কংগ্রেস ক্রমেই কোণঠাসা।
এক সময়ের শাসক দল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ’র এমন বাজে ফলের কারণ বিশ্লেষকরা বলছেন মূলত পাঁচটি।
দুর্বল নেতৃত্ব : সোনিয়া গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি থাকাকালে নেহরু-গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল। সোনিয়ার আমলে দুবার ইউপিএ জোটের ওপর ভর করে সরকার গঠন করে কংগ্রেস। তবে ২০১৪ সাল থেকে দলের মূল ভ‚মিকায় আসেন রাহুল। তারপর থেকে কংগ্রেসের নেতৃত্ব ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ে। জাতীয় চরিত্রের রাজনীতিক হিসেবে নিজের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে পারেননি রাহুল। যেটা পেরেছেন মোদি।
বিজেপিবিরোধী ইস্যু চাঙ্গা করা যায়নি : রাহুল বিজেপির বিরুদ্ধে বেশ কিছু ইস্যু নিয়ে ভোটের প্রচারে নেমেছিলেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য রাফায়েল দুর্নীতি, অর্থনীতির মন্দা গতি, কৃষক অসন্তোষ ও সংখ্যালঘু নির্যাতন। তবে এসব ইস্যুতে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন রাহুল।
আঞ্চলিক দলের আস্থাহীনতা : উত্তরপ্রদেশের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী ও অখিলেশ যাদবের সঙ্গে জোট গড়তে ব্যর্থ হন রাহুল। তাদের দৃষ্টিতে, রাহুলের রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা নেই। একই চিত্র পশ্চিমবঙ্গেও। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও তার নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হননি।
মোদিঝড় : প্রধানমন্ত্রী মোদি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত রাজনৈতিক ইস্যুতে ঝড় তুললেও রাহুল তা পারেননি। গণমাধ্যমে তার মুখ দেখা গেছে খুবই কম। মোদির মতো তিনি তেমন প্রচারে আসতে বা থাকতে পারেননি।
পারিবারিক রাজনীতির প্রতি অনীহা : বিজেপি যেভাবে গান্ধী পরিবার নিয়ে নেতিবাচক রাজনীতি করেছে, তা মোকাবেলা করতে পারেনি কংগ্রেস। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী ও রাজীব গান্ধীকে নিয়ে বিতর্কিত ইস্যু চাঙ্গা করে ভোটের মাঠে ফায়দা তুলেছেন মোদি ও অমিত শাহরা।
২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাস। সে সময়ই দেশের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির নাম ঘোষণা করেছিল বিজেপি নেতৃত্ব। তারপর থেকে আর কখনই পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি মোদিকে। মনমোহন সরকারকে সরিয়ে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসেন মোদি। তারপর থেকেই ক্রমাগত নিজের শক্তি বৃদ্ধি করে গেছেন তিনি। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই জনপ্রিয়তা বেড়েছে মোদির। সেবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের সাক্ষী ছিলেন ৮ দেশের প্রতিনিধি। প্রজাতন্ত্র দিবসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদির ভাষণ শুনতে ভারতে পা রেখেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। বিশ্ব দরবারে মোদি একটা ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। বিশ্বের তাবড় তাবড় নেতাদের সঙ্গে মোদির সম্পর্কের সেতু মজবুত হয়েছে।
রেডিওতে মোদির ‘মন কি বাত’-এ মজেছেন আম-আদমি। ‘মন কি বাত’-এর দৌলতে একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামেও পৌঁছে গিয়েছিলেন মোদি। বিরোধীদের থেকে লাগাতার আক্রমণ তার দিকে ধেয়ে এলেও, তা সুদৃঢ় হাতে মোকাবেলা করেছেন তিনি। দুর্নীতি ইস্যু থেকে জঙ্গি দমন, কিংবা দেশের উন্নয়নের কথা বলে মানুষের মন জিতে নিয়েছেন মোদি।
২০১৪ সালের নির্বাচনি প্রচারে মোদির মুখে শোনা গিয়েছিল ‘আচ্ছে দিন’। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় এলে তিনি দেশ বদলে দেবেন। ঘোষণা করেছিলেন স্বচ্ছ ভারত অভিযান। পাশাপাশি নির্মল গঙ্গা মিশন, মুদ্রা যোজনা, বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াওয়ের মতো মোদি সরকারের কর্মসূচিতে মজেছে জনতা। তিন তালাক নিষিদ্ধও একটা উল্লেখযোগ্য সিদ্ধান্ত। সবমিলিয়ে ‘সবকা সাথ সবকা বিকাশ’ মন্ত্রেই দেশবাসীর মন জিতেছেন মোদি। অন্যদিকে এবার তার বিরোধিতায় একাট্টা হতে পারেনি বিরোধী শিবির। দেশের উন্নয়নের স্লোগানের বদলে মোদির গীবত গাইতেই বেশি ব্যস্ত ছিল বিরোধীরা। যার ফলটা পশ্চিমবঙ্গে হাতেহাতে পেয়েছেন মমতা ব্যানার্জী। সেখানে ৪২ আসনের মধ্যে বিজেপি তুলে নিয়েছে ১৮ আসন। ২২ আসন জিতে কোনোমতো ক‚ল রক্ষা করেছে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস।
বরাবরই সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মোদি, কখনও পিছপা হননি। দেশের নিরাপত্তার স্বার্থই হোক কিংবা দল, সব ক্ষেত্রেই মোদি ‘রিস্ক’ নিয়েছেন। দেশের সুরক্ষার প্রশ্নে ২০১৬ সালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক কিংবা হালের এয়ার স্ট্রাইকে মোদি ঝড়ের বেগ আরও তীব্র হয়েছে বলেই মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের বিশ্বাস। তা ছাড়া সব থেকে চর্চিত নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত তো ‘নজিরবিহীন’।

দলিতদের ওপর অত্যাচার চালিয়েছে বিজেপি, বিরোধীদের এ অভিযোগকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রামনাথ কোবিন্দকে দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে মাস্টারস্ট্রেক দিয়েছিল মোদিবাহিনী। দলিত আইকন বি আর আম্বেদকরের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে দলিত শ্রেণির আরও কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন মোদি। অন্যদিকে গরিবদের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে জন ধন যোজনা, উজ্জ্বলা প্রকল্প, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, আয়ুষ্মান ভারতের মতো প্রকল্প চালু করে মোদি সরকার আমজনতার মনে ঠিকই ঠাঁই করে নেয়।

Comments are closed.

More News Of This Category